বাংলাদেশের বাউল সমাজ একটি সঙ্গীতাশ্রয়ী সাধন ভজন সাম্প্রদায়। হিন্দু, বৌদ্ধ এবং ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর মতো বাউল সাধনা নিম্নশ্রেণির মানুষের মধ্যে ব্যাপ্ত। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ এই সাধনাকে জীবন ও জগতে তাদের মুক্তির একমাত্র উপায়স্থল বলে ভেবেছে। প্রচলিত ধর্মের আচার অনুষ্ঠানকে পরিহার করে একটি স্বতন্ত্র মতাদর্শের মাধ্যমে পরম সত্যকে খুঁজে পাওয়াই তাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরনের সাধকদের সাক্ষাৎ মেলে। এদের সাধনায় নানা ধর্ম ও চেতনার সম্মিলন ঘটেছে। এরা কোনো জাতিভেদ মানে না। মানুষ ভজনা তাদের উপাসনা বিধায় সকল জাতের বা ধর্মের মানুষকে তারা তাদের সাধনধর্মে স্থান দিয়ে থাকে। এরা অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী। এদের সাধনা দেহভিত্তিক, তাই গুপ্ত। এরা পরিব্রাজক। গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে ভিক্ষা করাই একসময়ে এদের পেশা ছিল। কালের বিবর্তনে এদের সাধনায় যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি তাদের পেশায়ও। অবশ্য এদের মধ্যে যারা সংসারত্যাগী তারা আজও এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ভ্রমণ করে ফেরে। আখড়ায় আখড়ায় ঘোরা তাদের জীবন। এদের সাধনা যুগল সাধনা বলে তাদের সঙ্গী নারী। অতীতে এদের মধ্যে বিবাহের কোনো প্রথা ছিল না। কণ্ঠি বা মালা বদল করলেই সব হতো। এখনও বিয়েশাদির তেমন প্রয়োজন হয় না বাউলসাধকদের। যার সঙ্গে প্রয়োজন, চলে গেলেই হলো। কেউ তেমন আপত্তিও করে না। অবশ্য এই পদ্ধতি কেবল যারা পরিব্রাজক অর্থাৎ যারা আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়ায় কিংবা এখানে ওখানে গান গেয়ে ফেরে তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যারা গ্রামাঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করে তারা স্ত্রী-পুত্র নিয়েই বসবাস করে। এখানে উল্লেখ করা অসংঘত নয় যে, বাংলাদেশ যেমন মিশ্র জাতির সঙ্গমস্থল অর্থাৎ এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান এবং অন্যান্য জাতির আবাসভূমি, বাউল সাধনায় তেমনি বিভিন্ন ধর্মের এবং বর্ণের মানুষেরা স্থান পেয়েছে। এদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা খুব প্রবল। এদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনকে বহন করে এসেছে। বাউল সাহিত্যে বাউল সাম্প্রদায়ের সেই সাধনাকে। দেখি এ জিনিস হিন্দু মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু মুসলমানের কণ্ঠে মিলেছে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধেনি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে-বিরোধে বর্বরতা। বাংলাদেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল, কলেজের অগোচরে আপনা আপনি কী রকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তার পরিচয় পাওয়া যায়’ এই বাউল ধর্ম এবং বাউল গান বলতে কী আমাদের সংস্কৃতির অংশই শুধু নয়, বরং বলা চলে আমাদের সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নীরবে কাজ করে চলেছে।