বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ টের পেলেন তার পাথর কঠিন চোখজোড়াও ক্রমশই জলে ভরে উঠছে। কিন্তু বা হাত বাড়িয়ে রেণুকার অগোচরেই তিনি তার চোখের সেই জল মুছে ফেললেন। তিনি চান না এই জগতে দেবেন্দ্রনারায়ণের চোখের জল কেউ দেখুক। দেবেন্দ্রনারায়ণের চেয়ে কে আর বেশি জানে যে, কিছু কিছু মানুষ বুকের ভেতর আস্ত একটি নোনা জলের সমুদ্র লুকিয়ে রেখে খটখটে শুকনো চোখে সারাটাজীবন কাটিয়ে দেয়। সকলেই তার অশ্রুবিহীন সেই কঠিন চোখজোড়াই দেখে, বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা কষ্টজলের সমুদ্র কেউ দেখে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বিষ্ণুপুর জমিদারির অন্দরমহল শান্ত হয়েছে। কিন্তু সময় বলছে, সামনে অপেক্ষা করছে নতুন এক গল্প । বিবমিষার গভীর অন্ধকার থেকে উঁকি দেয়া নতুন এক আখ্যান। সেই আখ্যান জুড়ে অন্দরমহল। সেই অন্দরমহল শুধুমাত্র বিষ্ণুপুর জমিদারির কেন্দ্রস্থল। গঙ্গামহলেরই অন্দরমহল নয়, এই অন্দরমহল মন ও মানবেরও এক সুগভীর অন্দরমহল। ভূমিকাঃ 'ডেথ অব দ্য অথার’ বলে একটি কথা আছে। কথাটি আমি খুব বিশ্বাস করি। এই কথার মানে, কোনো বই পাঠকের কাছে যাওয়া মাত্র সেই বইয়ের লেখকের মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ লেখক কী ভেবে সেই বইটি লিখেছেন, লেখার সময় লেখকের অনুভূতি কী ছিল বা তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, পাঠক সেই মতে বইটি অনুধাবন করতে বাধ্য নন। পাঠকের নিজস্ব ভাবনা রয়েছে, অনুভূতি রয়েছে, জীবনের নানান অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং খুবই স্বাভাবিক যে পাঠক তার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই লেখাটি হৃদয়াঙ্গম করবেন। এটি পাঠকের স্বাধীনতা। সুতরাং পাঠকের কাছে যাওয়া মাত্র বই হয়ে যায় পাঠকের। মৃত্যু ঘটে লেখকের। তাহলে অন্দরমহল-এর ভূমিকা লেখার কারণ কী? ভূমিকা লেখার ছোট্ট একটি কারণ। কারণটি দায়মুক্তির। অন্দরমহল বহু পুরনো আমলের আবহে লেখা একটি উপন্যাস। ফলে উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সেই পুরনো আমলের সময়কাল কত? স্থানটি কোথায়? পুরনো উপন্যাসে খুব সচেতনভাবেই এই সময় ও স্থানের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এর কারণ, অন্দরমহলকে কোনোভাবেই ঐতিহাসিক উপন্যাসের কাতারে না ফেলতে চাওয়া। সুনির্দিষ্ট সময়কাল ও স্থান সেই সময়ে সংঘটিত নানান রাজনৈতিক, জাতীয়, প্রাকৃতিক ঘটনা, ভাষা ও নিয়ম নীতির সাপেক্ষে উপন্যাসের কাহিনীকে প্রভাবিত বা সংযুক্ত হতে বাধ্য করে। কিন্তু অন্দরমহল একটি শতভাগ ফিকশন'। এতে ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিককার কিছু অনুষঙ্গ ব্যবহার করা হলেও এই উপন্যাসের সাথে সে সময়ের বাস্তব কোনো ঘটনা, স্থান, কাল, পাত্র এমনকি সময়কালেরও সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি এই বাস্তবঘনিষ্ঠতা এড়াতেই উপন্যাসের গানগুলোও কোনো বাস্তব উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়নি। চরিত্র ও আবহ মাথায় রেখে এই উপন্যাসের জন্যই গানগুলো লেখা হয়েছে। অন্দরমহল মূলত এক হিন্দু জমিদার পরিবারের আখ্যান। এই হিন্দু জমিদার পরিবার-সংক্রান্ত নানান তথ্য দিয়ে অপরিসীম সমর্থন জুগিয়েছে কলকাতা থেকে রঞ্জু প্রসাদ মণ্ডল রঞ্জুকে ধন্যবাদ। সবশেষে, পাঠক, অপার স্বাধীনতায় ভাবনার উন্মুক্ত আকাশ নিয়ে প্রবেশ করতে পারেন অন্দরমহল-এ। কারণ অন্দরমহল বিশুদ্ধ কল্পনার নির্যাস । সাদাত হোসাইন ১১ জানুয়ারি ২০১৬ অন্দরমহল বইয়ের কিছু কথাঃ ভয়াবহ দুঃসংবাদটা এলো রাত্রির তৃতীয় প্রহরে । পেয়াদা রঘু এসে যখন খবরটা দিল, তখন বিষ্ণুপুরের হবু জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণ কেবল ঘুমাতে যাচ্ছিলেন। রবিবার দিবাগত রাতে দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিকটা মদ্যপান করেন। বিষ্ণুপুর জমিদারির উত্তর তল্লাট ঘেঁষে শুরু হয়েছে বারোহাটির বিশাল জঙ্গল। জঙ্গলের গা ঘেঁষে দেবেন্দ্রনারায়ণের বাগানবাড়ি। দেবেন্দ্রনারায়ণ মাসের কোনো এক রবিবার এই বাগানবাড়িতে রাত্রিযাপন করেন। মাঝরাত অবধি নাচগান হয়। তবে সেই নাচগানের জলসায় লোকজনের সমাগম থাকে না। সংগীত বা নৃত্যপিপাসু মানুষ থাকে না। থাকেন দেবেন্দ্রনারায়ণ একা। আর থাকে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রুপবতী বাঈজির দল। তাদের পর্যাপ্ত সম্মানির ব্যবস্থা থাকে। তারা সারারাত ধরে দেবেন্দ্রনারায়ণের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণের মনোরঞ্জন করা সহজ কোনো ব্যাপার নয়। এই প্রায় পঞ্চাশেই জগতের বেশির ভাগ ভোগবিলাসের সাথে দেবেন্দ্রনারায়ণের পরিচয় হয়েছে। সম্ভাব্য সকল কিছুর স্বাদ নেয়ার চেষ্টা তিনি করেছেন। ফলে আজকাল তার ভেতর একধরনের অতৃপ্তির হাহাকার দেখা যায়। কোনো কিছুতেই যেন তিনি তুষ্ট হতে পারেন না। | আজ তার শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে রাইপুরের বিখ্যাত নর্তকী হেমাঙ্গিনী দেবী। হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেবেন্দ্রনারায়ণ বিশেষ পছন্দ করেন। এককালে হেমাঙ্গিনী দেবী অহরহ আসত এই বিষ্ণুপুরে। বারোহাটির এই বাগানবাড়ি ছিল তার নিয়মিত নিবাস। কেউ কেউ বলাবলি করছিল যে, বিষ্ণুপুর জমিদারির মেজোকুমার দেবেন্দ্রনারায়ণ বুঝি হেমাঙ্গিনী দেবীর প্রেমে পড়েছেন। তাহলে কি জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের মেজোপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণ নর্তকী বিয়ে করবেন! এই নিয়ে নানান কানাঘুষা। ঘটনা অনেকদূর গড়িয়েছিলও। তবে শেষ অবধি হেমাঙ্গিনী দেবীর আর জমিদার বাড়ির বউ হওয়া হয়ে ওঠেনি। এত ঘটনার পরও দেবেন্দ্রনারায়ণ কখনো ডাকলে ছুটে আসে হেমাঙ্গিনী দেবী। এবারও এসেছে। তবে এবার সে এসেছে বহু বছর বাদে। সদা হাস্যময়ী হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেখে তার অন্তর্জগতের খবর বোঝার উপায় নেই। সে অন্দরমহল ৯ লেখকের কথাঃ সাদাত হোসাইন স্নাতকোত্তর- নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দুটো ইচ্ছে নিয়ে স্বপ্নযাত্রার শুরু। এক- খেয়ানৌকার মাঝি হওয়া, দুই- নিজের নামটি ছাপার অক্ষরে দেখতে পাওয়া। মাদারীপুরের কালকিনি থানার কয়ারিয়া নামের যে গ্রামে জন্ম, তার পাশ দিয়েই তিরতির করে বয়ে গেছে ছোট্ট এক নদী। খেয়ানৌকার মাঝি হওয়ার স্বপ্নটা তাই সত্যি হওয়াই ছিল সহজ। কিন্তু হলো উল্টোটা। পূরণ হলো দ্বিতীয় স্বপ্নটি! সাদাত হোসাইন হয়ে গেলেন লেখক। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়। লিখেছেন কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস। যা প্রশংসা কুড়িয়েছে পাঠকমহলে। আরশিনগর নামের দীর্ঘ কলেবরের উপন্যাসটি রীতিমত চমকে দিয়েছে পাঠকদের। শুধু লেখালেখিই নয়, দুর্দান্ত আলোকচিত্রী সাদাত হোসাইন নিজের স্বপ্নের সীমানাটাকে বাড়িয়ে নিয়ে গেলেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণেও। তার নির্মিত বোধ শর্টফিল্মটি প্রশংসার ঝড় তুলেছে বিশ্বব্যাপী। কাজ করছেন একাধিক নতুন ফিল্ম নিয়ে। সাদাত হোসাইনের জগত জুড়ে অমিত স্বপ্নের বাস। সেই স্বপ্নের সবটা ছুঁয়ে ছুটে যেতে চান অবিরাম। সম্প্রতি আলোকচিত্র, লেখালেখি এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য জিতেছেন ‘জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যশনাল অ্যাওয়ার্ড’ । প্রচ্ছদ । হাসিবুল ইসলাম নাসিম লেখকের ছবি = নাইমুল হক টিটু
স্নাতকোত্তর, নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সাদাত হোসাইন নিজেকে বলেন গল্পের মানুষ। তাঁর কাছে চারপাশের জীবন ও জগত, মন ও মানুষ সকলই গল্প। তিনি মনে করেন, সিনেমা থেকে পেইন্টিং, আলোকচিত্র থেকে ভাস্কর্য, গান থেকে কবিতা- উপন্যাস-নাটক, সৃজনশীল এই প্রতিটি মাধ্যমই মূলত গল্প বলে। গল্প বলার সেই আগ্রহ থেকেই একের পর এক লিখেছেন- আরশিনগর, অন্দরমহল, মানবজনম, নিঃসঙ্গ নক্ষত্র, নির্বাসন, ছদ্মবেশ, মেঘেদের দিন ও অর্ধবৃত্তের মতো তুমুল জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘কাজল চোখের মেয়ে’, তোমাকে দেখার অসুখ'সহ দারুণ সব পাঠকপ্রিয় কবিতার বই। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বোধ, দ্য শুজ, প্রযত্নের পাশাপাশি' নির্মাণ করেছেন 'গহীনের গান' এর মতো ব্যতিক্রমধর্মী পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও। জিতেছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকার পুরস্কার, এসবিএসপি-আরপি ফাউন্ডেশন সাহিত্য পুরস্কার, পশ্চমিবঙ্গের চোখ সাহত্যি পুরস্কার, শুভজন সাহিত্য সম্মাননা ও এক্সিম ব্যাংক- অন্যদিন হুমায়ূন আহমদে সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯। তাঁর জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মে, মাদারীপুর জেলার, কালকিনি থানার কয়ারিয়া গ্রামে।