"একজন দুর্বল মানুষ" বইয়ের পিছনের কভারের লেখা: কয়েক বছর আগে একজনের বাড়িতে একটি বই দেখেছিলাম, নামটা বেশ অদ্ভুত -কপােট্রনিক সুখদুঃখ। বইটি চেয়ে এনে পড়লাম। পড়ার পর বুঝলাম এটি একটি সায়ান্স ফিকসান। পড়ে এত ভাল লেগে গেল যে, কয়েকদিনের মধ্যেই বইয়ের দোকানে খুঁজে এই লেখকের লেখা আরাে কয়েকটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বই কিনে ফেললাম। লেখককে তখন চিনতাম না, কিন্তু তার বই পড়ে মুগ্ধ হলাম। ভাবলাম লেখক যে-ই হােন, তাঁর লেখার শক্তি আছে। নিউজার্সীতে এসে তার সঙ্গে পরিচয় হল, তিনি মুহম্মদ জাফর ইকবাল। অল্প বয়স্ক তরুণ, এখানে পি. এইচ. ডি. করতে এসেছিলেন কয়েক বছর আগে। ডিগ্রি শেষ করে এখন চাকরি করছেন। শীগগীরই দেশে ফিরে যাবেন। তিনি আমাকে তাঁর লেখা ছােটগল্পের বই ‘একজন দুর্বল মানুষ’ পড়তে দিলেন। বইটি পড়ে অভিভূত হলাম। ছােটগল্প রচনাতেও তার সমান দক্ষতা। গল্পগুলি সবই মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা। এরমধ্যে একটি আত্মজৈবনিক-পাকিস্তানী মিলিটারীর হাতে তাঁর পিতার মৃত্যুবরণের পর কিভাবে গ্রামে গ্রামে লুকিয়ে মা ও ভাইবােনসহ তার দিন কেটেছে-তারই মর্মস্পর্শী বিবরণ। বিভিন্ন গ্রামে, বিভিন্ন পরিবেশে বাস করার সময় লেখক তৎকালীন জন-জীবন গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার ছাপ রয়েছে গল্পগুলিতে। সবগুলি গল্পই মুক্তিযুদ্ধের ওপর হলেও এগুলির মধ্যে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য আছে। একেক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী একেক রকম, একেক জনের জীবনে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা একেক রকম ভাবে ছাপ ফেলেছে, লেখকের বিভিন্ন গল্পে তার বিভিন্ন চিত্রণ লক্ষ্য করা যায়। ফলে পড়তে পড়তে একঘেয়ে লাগে না। লেখকের প্রকাশভঙ্গী মনােরম, একই সঙ্গে আবেগমথিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত । মানব-জীবন-যাবন-প্রণালীর মধ্যে নানা অসঙ্গতি থাকে, লেখক সেগুলি কৌতুক-স্নিগ্ধ চোখে লক্ষ্য করেছেন এবং তার বিভিন্ন গল্পের মাঝে মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধের মতাে ভয়ানক, প্রাণান্তক এবং মর্মস্পশী ঘটনার মধ্যেও মানবজীবনের নানা কৌতুককর দিকের চিত্র তাঁর লেখনীতে হঠাৎ হঠাৎ ঝলক দিয়ে উঠেছে, একারণেই গল্পগুলি পড়তে পড়তে দম-আটকানাে বুক-চাপা কষ্টের মধ্যেও একটুখানি হাঁফ ছাড়ার অবকাশ পাওয়া যায়। একজন দুর্বল মানুষ’ পড়ে আমার মনে হয়েছে, লেখকের অন্যান্য বইয়ে চেয়েও এই বই বেশি জনপ্রিয় হবে, কারণ গল্পগুলির বিষয়বস্তু হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্ম এখন মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক লেখাই বেশি পড়তে চায়। এই বই বাংলাসাহিত্যে এক অনন্য সংযােজন হিসেবে গন্য হবে বলে আশা করি। জাহানারা ইমাম
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরী পাঠকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি মূলত এ দেশের একজন বিখ্যাত লেখক, পদার্থবিদ এবং শিক্ষাবিদ। কিশোর সাহিত্য, শিশুতোষ গ্রন্থ, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, গণিত বিষয়ক বই এর জন্য খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা বাবা ফয়জুর রহমানের চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলাতেই তিনি পড়াশোনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে পিএইচডি ডিগ্রী অজর্নের উদ্দেশ্যে স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি সম্পন্ন করে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ ল্যাবেও গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সবসময়ই এ দেশের কিশোর-কিশোরীদের কাছে বিশেষ আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে। কিশোর সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক অজস্র গ্রন্থ দিয়ে তিনি আলোকিত করে তুলেছেন এদেশের অগণিত কিশোর-কিশোরীর মনোজগত। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সমূহ, যেমন- দীপু নাম্বার টু, আমার বন্ধু রাশেদ, আমি তপু, শান্তা পরিবার, দস্যি ক’জন ইত্যাদি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। তার বেশ কিছু গল্প পরবর্তীতে নাটক ও চলচ্চিত্র হিসেবে টিভি পর্দায় স্থান করে নিয়েছে। তিনি একজন বিশিষ্ট কলামিস্টও। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডও তাঁর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সমগ্র সকল বইপড়ুয়াকেই আকৃষ্ট করে। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বহুবার পুরষ্কৃত হয়েছেন। বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (২০০৪) এবং শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার (২০০৫) সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক (২০০২), শেলটেক সাহিত্য পদক (২০০৩), ইউরো শিশুসাহিত্য পদকসহ (২০০৪) অগণিত পুরষ্কার অর্জন করেছেন গুণী এই সাহিত্যিক।