এই সেই হিথরো। হিথরো এয়ারপোর্ট। লোকে বলে লন্ডন। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কথা আলাদা। তাছাড়া সারা দুনিয়ার সবাই বলে লন্ডন ৷ কোন এয়ারপোর্টেই নিজের নামে পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত নয়। ওরলিকে বলে প্যারিস, জন এফ কেনেডির স্মৃতি অম্লান রাখার জন্য লগেজ ট্যাগে জে-এফ-কে লেখা থাকলেও মোটা মোটা অক্ষরে ছাপা থাকে নিউইয়র্ক। অথবা এন-ওয়াই-সি। সব দেশে সর্বত্র এয়ারপোর্টের নিজস্ব পরিচয় উপেক্ষিত। আমাদের দেশেও। পালামে রঙিন আলোয় বিরাট করে লেখা আছে দিল্লী এয়ারপোর্ট। দমদমে প্লেন ল্যান্ড করার আগে অনেক প্লেন কোম্পানীর এয়ার হোস্টেসই অ্যানাউন্স করে, উই উইল বী সর্টলি ল্যান্ডিং অ্যাট ক্যালকাটা এয়ারপোর্ট। লোক্যাল টাইম ইজ টেন পাস্ট সিক্স এ্যন্ড আউট সাইড টেম্পারেচার ইজ ফিফটিন পয়েন্ট টু ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড।...... আশ্চর্য। শুধু আশ্চর্য নয়, দুঃখের। আপন নামে, মর্যাদায় পরিচিত হবার মধ্যে একটা আনন্দ, আত্মতৃপ্তি আছে। এই আনন্দ আত্মতৃপ্তিটুকু পাবার অধিকার সবার। সব কিছুর। এয়ারপোর্টের কপালে তা জোটে না। অনেকটা আমাদের দেশের বিবাহিতা মেয়েদের মত সুমিত্রা, সুচিত্রা নন্দিতা, প্রমীলা হয়ে যায় বড় বৌমা, মেজ বৌদি, গোরার বৌ। বড় জোর মিসেস ব্যানার্জি, মিসেস ঘোষ বা মিসেস সেন । এসব কথা ভাবতে গেলেই আমার পিয়ালীর কথা মনে পড়ে। আমার সঙ্গেই কমলা গার্লস স্কুলে পড়ত। কি দারুণ মিষ্টি নাম। ছেলেদের চাইতে মেয়েদের নাম অনেক সুন্দর । অনেক বেশি কাব্যিক হয় কিন্তু পিয়ালীর মত এত সুন্দর, মিষ্টি নাম আমি শুনি নি। ওকে দেখতেও ভারি সুন্দর ছিল। রোজ টিফিনের সময়, ছুটির পরে আমি ওর গাল টিপে আদর করে ডাকতাম, এই পিয়া, পিয়ালী, শোন। আমার ডাক শুনে মনে মনে খুশি হলেও লজ্জায় পিয়ালীর সুন্দর মুখখানা আরো সুন্দর হয়ে উঠত। ও মুখ টিপে টিপে হাসতে হাসতে আমার কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করত, কি বলছিস ?
বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন তিনি। শিক্ষাজীবন: নির্মম অদৃষ্ট সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শেণীতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বাবুও এক সময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাশ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার স্বীকার হন। নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি. আই. পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘মেমসাহেব’, ‘ডিপেস্নাম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনক্যলাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে।