"মেধাবী ও বিনয়ী মানুষের গল্প”বইটির ভূমিকা:
গােটা পৃথিবী ৬০-১৪০ ন্যানােমিটার দীর্ঘ ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে হিমশিম খাচ্ছে। উন্নত দেশের মতাে আমাদের জনজীবনও ওষ্ঠাগত। আমাদের সমাজ, দেশ ও জাতি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয়, অন্যায়, অনাচার ও দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি শিশু, কিশাের ও তরুণতরুণীরা। জীবনকে বিকশিত করার জন্য স্বপ্ন তারা দেখতে পারছে না। দেওয়ালে দেওয়ালে, পােস্টারে, খবরের কাগজে যেসব দুর্বল চরিত্রের নেতার ছবি এবং স্তুতিবাক্য উচ্চারিত হয় আমাদের তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা তাদের জন্য রােলমডেল ভাবতে পারছে না। শিশু-কিশােরদের স্বপ্ন দেখার অপারগতা অন্ধকার ভবিষ্যৎকে নির্দেশ করে। দেশে মেধার লালন ও স্বীকৃতি হ্রাস পাচ্ছে। তাই চিকিৎসা, প্রকৌশল, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, কৃষিবিজ্ঞান কিংবা অর্থনীতি, ভাষাসহ সকল বিষয়ের ভালাে ছাত্ররাই তাদের বিষয় জ্ঞানকে তুচ্ছ করে লােভনীয়, ক্ষমতাকেন্দ্রিক পেশায় নিয়ােজিত হতে বদ্ধপরিকর, যদিও তাদের বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা দিতে জাতিকে অনেক বিনিয়ােগ করতে হয়েছে। এবং সেই বিষয়গুলােতে দেশে বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে বলেই বিদেশী বিশেষজ্ঞরা নিযুক্ত হচ্ছে এবং বড়াে বিশাল অঙ্কের পারিশ্রমিক নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যখন মহাপরাধীন ছিলাম তখন জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন বােস, মেঘনাদ সাহার মতাে কালজয়ী প্রতিভা আমাদের মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেছিল। আজ একাধিকবার স্বাধীন হওয়ার পরও সমমানের বিজ্ঞানীর জন্ম হচ্ছে না – তাও মেধার প্রতি চরম অবজ্ঞা, উদাসীনতার ফলেই। ইরানের শ্রেষ্ঠ সন্তান মরিয়ম মির্যাখানি একমাত্র নারী ফিল্ডস মেডাল বিজয়ী হয়েছিলেন এবং ইরানের প্রচলিত আইনকানুনের পরিপন্থি পারিবারিক জীবনযাপন করছিলেন। এমনকি ইরানের রক্ষণশীল সমাজ এবং সরকার তার মহাপ্রয়াণে গােটা জাতি, সরকার একত্র হয়ে তার প্রশংসায় ভেসেছিল। প্রচলিত নিয়মকানুন ভেঙে এই মেধাবী সন্তানের জন্য দেশের আইনও পরিবর্তন করার জন্য তৎপর হয়েছিল।
ব্যক্তিগতভাবে চিনি, যাদের সংস্পর্শে আসার আমার সুযােগ হয়েছে, যাদের সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জানার সুযােগ হয়েছে, বিশেষ করে আমাদের ছাত্র, তাদের সম্পর্কেই আমি লিখেছি। লব্ধপ্রতিষ্ঠ যন্ত্রকৌশলী অধ্যাপক ফজলে হােসেন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের তরুণ মেধাবী অধ্যাপক সাঈফ সালাউদ্দিন, পার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক আইইইই-এর ফেলাে আশরাফ আলম; ভার্জিনিয়া টেকের অধ্যাপক সাইফুর রহমান, কানাডার মেমােরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আজিজুর রহমান, নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মােহাম্মদ ফজলুর রহমান, ওয়েস্ট ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা অধ্যাপক মুহাম্মদ হারুনুর রশিদ, ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা অধ্যাপক আনােয়ার হাসান, ইলেকট্রিক পাওয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ডঃ আরশাদ মনসুর, নর্থ ক্যারােলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইকবাল হােসেন, সাউথ আলাবামার অধ্যাপক শওকত আলমসহ কম্পিউটারবিজ্ঞান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ বিজ্ঞানী কিংবা প্রকৌশলীদের সম্পর্কে লেখা হয়নি। ভবিষ্যতে তাদের নিয়ে লেখার দুঃসাহস দেখাতে পারি, যদি এই বইটি এর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের কিছুটা হলেও অর্জন করতে পারে। ইদানীংকালে গ্রামাঞ্চল এবং আর্থিকভাবে তুলনামূলকভাবে অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতায় উচ্চশিক্ষা এবং জীবনে প্রতিষ্ঠা অর্জনে কাক্ষিত হারে সফল হচ্ছে না। এদের উৎসাহিত করার জন্য বৈরী পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন এমন অনেক নামকরা বিজ্ঞানী সম্পর্কেও যেমন লিখেছি, ঠিক তেমনি আমাদের সমাজে বড়াে হয়ে ওঠা এবং উঠন্ত বয়সের প্রতিভাধরদের নিয়েও লিখেছি। আমার লেখায় অনেক অসঙ্গতি ও ত্রুটি ছিল। শেষ মুহূর্তে আমার ছােট ছেলে সুমিত এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য বেশ কিছু ভুল সংশােধন করেছে। এই বইয়ের টাইপসেটিং এবং অন্যান্য ভুল ও অসংগতি থাকার দায় আমার। বইটি প্রকাশ করার জন্য সােহাগকে কৃতজ্ঞতা জানাই। বই আকারে আনার জন্য রকমারি ডট কম-এর উদ্যোগী তরুণ জাহিদ, রুবেল ও মারুফকে ধন্যবাদ জানাই। শেষের ফ্লাপের কিছু কথা :
শহরভিত্তিক নয়, এমন দেশসমূহের মধ্যে আমাদের দেশের জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি এবং পৃথিবীর গড় জনঘনত্বের ২৪ গুণ বেশি। তুলনামূলকভাবে অবহেলিত জনগােষ্ঠীর হাড়ভাঙা পরিশ্রমে মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্স এবং তৈরি পােশাকশিল্পের কর্মীদের শ্রমের থেকে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভর করে আমাদের দেশটি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে; এবং এখন আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের যােগ্যতা অর্জন করেছি। মধ্যম কিংবা উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তরের স্বপ্নটি বাস্তবায়নের জন্য চাই বিশ্বমানের জ্ঞান ও দক্ষতা। এখনাে বিদেশি পরামর্শক ও বিশেষজ্ঞদের ফিয়ের নামে প্রতিবছর প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। একদিকে যেমন আমাদের মধ্যে দেশপ্রেমে উদ্ভাসিত হতে হবে, অন্যদিকে বিশ্বমানের সদক্ষতাও অর্জন করতে হবে, যাতে করে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের অর্থ বিশেষজ্ঞদের নামে বাইরে চলে না যায়। আমার কর্মস্থল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগ হওয়ার ফলে অসংখ্য মেধাবী, গুণী ছাত্র ও শিক্ষকের সঙ্গে যােগাযােগের সুযােগ হয়েছে, যা আমাকে আমার শিক্ষকতা-জীবনের শুরুতে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। জাতীয় দৈনিকসমূহে তাঁদের নিয়ে যে লেখাগুলাে লিখেছিলাম তার সংকলন হিসাবে মেধাবী মানুষের গল্প বইটি অন্যপ্রকাশ ২০০৫ সালে প্রকাশ করেছিল এবং ২০০৭ সালে পুনর্মুদ্রণ করেছিল। এবার পাইল্যাব ও অন্যরকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হাসান সােহাগের উৎসাহে ১৫ বছর পর ঐ মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে এবং আরাে কিছু ব্যক্তিত্ব নিয়ে মেধাবী ও বিনয়ী মানুষের গল্প বইটি প্রকাশিত হলাে।
Read More