সূ ত্র পা ত নৌকার নাম ‘বারকি’। নির্মাণকাহিনি উদ্ভাবনচিন্তায় মাইলফলক। নির্মাতা ব্রিটিশ নাগরিক জন বারকি। স্থানীয় ইতিহাস বলছে, চুনশিল্প-বাণিজ্যের স্বর্ণযুগে দলে দলে ব্রিটিশ নাগরিকেরা এদেশে আসেন। নানা পেশা, নানা ব্যবসার তালাশ চলে। সিলেটের নৌপথে জাহাজ ছাড়াও বড় বড় মালবাহী নৌযান চলত চুনাপাথর নিয়ে। জন বারকি ছিলেন কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত সরকারি চাকরিজীবী। ব্যবসা করতে চাকরি ছেড়ে দেন। নদীতে চুনাপাথর পরিবহন কসরত দেখে বিচলিত ছিলেন। ব্যবসার পাশাপাশি নতুন একটি কর্ম খোঁজার চেষ্টা চলে। তার কোনো নৌযান ছিল না। বড় বড় নৌযানে অনেক খরচ। এ খরচ সামাল দিতে নিজেই তৈরি করেন সাদাসিধে লম্বাটে নৌকা। চুনাপাথর পরিবহন করে জলপথে নতুন এ নৌকা। প্রথম কারিগর জন বারকি, প্রথম চালকও তিনি। এ জন্য তার নামে পরিচিতি পায় ‘বারকি নৌকা’। জন বারকির গল্প ধরে হিসেব করলে আড়াই-তিনশ বছরের পুরোনো বারকি নৌকা। নির্মাণস্থল ব্রিটিশ আমলে শিল্পশহরখ্যাত সুনামগঞ্জের ছাতকের আশপাশ। প্রথম চলেছে সুরমা নদী দিয়ে ইছাকলস হয়ে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পাড়ুয়া-ভোলাগঞ্জ এলাকায়। এরপর ঝাঁকে ঝাঁকে বারকি চলেছে, চলছে সুরমা-কুশিয়ারা ছাড়াও চেঙ্গের খাল, গুয়াইন, সারী, লোভা, পিয়াইন, ডাউকি, ধলাই, চলতি, রক্তি, বৌলাই, জাদুকাটা হয়ে সমগ্র সিলেটের জলপথে। যন্ত্রের সঙ্গে লড়ে পৃথিবীর বুকে জীবন্ত ইতিহাস হয়ে আছেন মার্কিন লোকগাথার জন হেনরি। জন বারকি! জন হেনরি! নামে খানিক মিল। তবে মানুষ ও প্রেক্ষাপটে বিস্তর অমিল। অবশ্য একদিক দিয়ে বড় এক মিল। একা লড়ার সাহস। এক জন বারকির কারিগরি চিন্তা ও কর্মে নির্মিত নৌকা জলপথে শ্রমজীবিকার নতুন সূত্রপাতের ঐতিহ্য বহন করছে। যতদিন নদী-জলাভূমি থাকবে, যতদিন শ্রম ও জলজীবিকা থাকবে, ঠিক ততদিনই টিকে থাকবে বাড়তি শ্রমের জলযান এই বারকি নৌকা। জন বারকি কোথায়? কেন চলে গেলেন? তাঁকে কি তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল? কী তার ইতিহাস? এমন অনেক প্রশ্ন। উত্তরে কেবল ধারণা ছাড়া কংক্রিট কোনো তথ্য নেই। ব্রিটিশ শাসনামলে সিলেটের প্রথম কালেক্টরেট উইলিয়াম ম্যাইকপিস থ্যাকারের ভারতজীবন গ্রন্থের অনুবাদক ফেরদৌস টিপুর অনুবাদ-সুবাদে জানা হয় হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ নৌ-কারিগরির কারখানা। তাতে কেবল জন ব্লেয়ার নামক একজন ‘কন্ট্রাক্টর’-এর নাম পাওয়া যায়, যার অধীন ছিল নৌকার কারিগররা। ... তখন নৌকো নির্মাণের জন্য দক্ষ কারিগর পাওয়াও কঠিন ছিল; যদিও এ জন্য ঢাকার চিফ এবং সিলেটের কালেক্টরেট পরোয়ানা জারি করেছিলেন। এতৎসত্ত্বেও কন্ট্রাক্টর রিচার্ডসন খুবই কম সংখ্যক কারিগর জোগাড় করতে সক্ষম হন। তিনি লেখেছেন, ‘এ নিয়ে আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি। আমার হাতে এখন যতগুলো নির্মাণাধীন নৌকো আছে, কারিগরি সাহায্য না-পেলে সেগুলো বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে প্রস্তুত করা যাবে না। ফলে পণ্য বোঝাইয়ের জন্য নৌকোর সংকট দেখা দেবে।’ এরপর তিনি হতাশ হয়ে কাতর কণ্ঠে বলেন, ‘আমি যদি পূর্বের কন্ট্রাক্টর (মৃত) জন ব্লেয়ারের কারিগরদের আমার কাজে নিয়োগ করতে পারতাম, তাহলে এ বিষয়ে আপনাদের বিরক্ত করার প্রয়োজন হত না। ... উইলিয়াম ম্যাইকপিস থ্যাকারের ভারতজীবন, পৃ. ১৮৫-১৮৬ এই তথ্যসূত্রে সহজে অনুমেয়, নৌকা নির্মাণে কারিগরি দলে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল শাসকদের। ইংরেজ প্রশাসন সাজানোর সময়কার সেই কন্ট্রাক্টর জন ব্লেয়ার কি জন বারকির রক্তের সম্পর্কের কেউ? জানা সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর এক প্রান্তসীমায় জন বারকি বলা চলে প্রান্তজন। প্রান্তজনের ইতিহাস গাথা হয় না। বারকি নৌকা আছে, বারকিপুর নামে আছে গ্রাম, আছে টিলাও। এতসব আছের মধ্যেও নেই জন বারকি! সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম আলীরগাঁও ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম বারকিপুর। কেন, কী করে? জানার আগ্রহে একদিন সিলেটের প্রত্নসম্পদ গ্রন্থের লেখক ও গবেষক মোহাম্মদ আবদুল হাইকে সঙ্গী করে বারকিপুর গ্রামে যাই। স্থানীয় সাংবাদিক মঞ্জুর আহমদ বারকিপুর জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে ছোট পরিসরে বসার আয়োজন করেন। সেখানে প্রবীণ মানুষজনের সঙ্গে একান্তে কথা বলি। গ্রামের বসতির ইতিহাস বহু পুরোনো। নামকরণে দুই রকম তথ্য। একটি ‘বাড়তি’ থেকে বারকি হয়েছে। বাড়তিপুর থেকে বারকিপুর। আরেক তথ্য, ব্রিটিশ জরিপকালে মৌজার নাম বারকিপুর। এই তথ্যে অনুসন্ধান পথ বের হয়। বারকি নৌকার কারিগর জন বারকি কিছুকাল আশ্রয় নিয়েছিলেন ওই এলাকায়। এ জন্য ব্রিটিশ জরিপে প্রীতি থেকে জন বারকির নামে এলাকার নামকরণ নথিতে স্থান করে নেয়। এসব কথিত কথা। কোনো নথি নেই। তাই বারকিপুর গ্রামবাসীকেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যায়নি। এ গ্রামে অর্ধশত বছর আগে স্থপিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শত বছরের পুরোনো মক্তব-জামে মসজিদের নামও বারকিপুর। টিলার নাম ‘বারেক্কের টিলা’। বারকি থেকে কি? সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের জাদুকাটা নদীর সীমান্তমোহনায় এই টিলা। এটি পেরিয়ে যেতে হয় রাজাই গ্রামে। পরাধীন ভূখণ্ডে এক খণ্ড স্বাধীনভূম। ওপাশে পুরাণলাউড়ের গড়। প্রাচীন রাজ্যের রাজধানী হলহলিয়া। এসব জায়গার জলপথ ছিল তখন প্রধানতম যাতায়াত। বারকি চলেছে, এখনো চলমান। জলপথে জন বারকির যাতায়াত ওই সব এলাকাতেও ছিল। ‘বারেক্কের টিলা’ নামটি কি বারেক থেকে বারেক্ক? এই বারেক কে? জন বারকি কী? কোনো তথ্য নেই! বরং বারেক নাম থেকে টিলার নামকরণ-এ রকম কথা লোকমুখে প্রচলিত। কথিত আরেকটি ঘটনার খোঁজে ধলাই নদ অববাহিক ভোলাগঞ্জের পাড়ুয়া গ্রামে যাওয়া। সেখানে অনেকবার অন্য কোনো কাজে যাওয়া হয়েছে। এবার শুধু বারকি নিয়ে। সেকালের গহীনঘর বা গুমঘর এখনো আছে। বারকি নৌকার উদ্ভাবককে গুম করার ঘটনাটি নিছক গল্প, কল্পিত। কথিতও নয়, নথিপত্র তো নেই-ই। এমনটা মনে করেন স্থানীয় লোকজন। কোম্পানীগঞ্জের পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন জানান, ঘটনাটি লোকমুখে শুনেছেন এমন প্রবীণ ব্যক্তিরও দেখা পাওয়া যায়নি। দুই-আড়াই শতাব্দীকালের জং ধরা একটি গুম-পীড়নের গল্প শুনে মন্তব্য কেবল হলেও হতে পারে! কারো মুখে আবার বিরূপ মন্তব্য, ‘বাপের জনমেও শুনিনি’! তবে বারকি নৌকা প্রথম চলাচল করার বিষয়টি তাঁরা শুনেছেন। সিলেট সদর-কোম্পানীগঞ্জ-গোয়াইনঘাট। তিন উপজেলার মিলনস্থলের সালুটিকর। বেশ পুরোনো গ্রাম্য হাট। তিনশ বছরের ঐতিহ্যবাহী। সালুটিকরের নৌকার হাটে বেশির ভাগ বারকি নৌকা কেনাবেচা হয়। জন বারকির খোঁজে সালুটিকরে একাধিকবার গিয়েও পাওয়া যায়নি কোনো তথ্য। নৌকা তৈরির গ্রাম মাইজবাড়িতে কথিত আছে, বারিক নামের এক ব্যক্তি ইংরেজ কারিগরের কাছ থেকে জেনে প্রথম নৌকা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এই বারিকের কোনো বংশ লতিকা নেই বলে জানালেন মাইজবাড়ির বাসিন্দা জহুর আহমদ। বারকি থেকে বারিক-তথ্যেও ভিত্তির নাগাল পাওয়া দুষ্কর। এই উপাখ্যান পেশার পথ পরিক্রমায় যৎকিঞ্চিৎ তথ্য, প্রচলিত গল্প ও ব্রিটিশ শাসনকালের প্রথম ভাগে জলপথের জমজমাট ইতিহাসের পথ বেয়ে এবং সরেজমিন খোঁজাখুঁজির। সত্যে ভর করে শুরু, শেষ হয়েছে সত্য-কল্পে-ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ের সুবলং অরণ্যে। শুরু ও শেষের পরও থাকে আরও কিছু। তাই এ কাহিনির যবনিকাপাত এখনই নয়। জগৎ-জন্ম-জীবন নিয়ে অনুসন্ধান কখনও শেষ হয় না। বারকি-জীবন ও জন্মবৃত্তান্তের এ কাহিনিরও শেষ নেই। মানচিত্র ও মানুষের কথায় ইতিহাস চলমান থাকে, নতুন কোনো তথ্যে কাহিনিও শোধরায়। এই অনুষঙ্গে না হোক-পরবর্তী কোনো কালে, কোনো উজ্জ্বল মেহেদীর সঙ্গে জন বারকির উত্তরসূরি কারো সাক্ষাৎকারের প্রত্যাশা প্রবল। এই প্রাবল্যে জলজীবিকার জলোপাখ্যান-বারকি, জন বারকি। উজ্জ্বল মেহেদী