ফ্ল্যাপে লিখা কথা জাফর ইকবালের লেখনীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় বেশ দীর্ঘ হলেও বর্তমান গ্রন্থটিকে বিশেষ শ্রেণীভুক্ত করতে সমালোচকদের বোধহয় একটু ভাবনাক্রান্ত হতে হবে। লেখক তাঁর জীবনের, বিশেষত তরুণ বয়সের নানান টুকরো টুকরো কাহিনীর সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন, তাতে বইটি আবশ্যিকভাবেই একটা আত্মজৈবনিক চরিত্র অর্জন করে। লেখক তাঁর জীবনের একটা কালসীমার মধ্যে নিজের মতো করে কিছু ঘটনা, কাহিনী ও অভিজ্ঞতা নির্বাচন করেছেন। সহজ-সাবলীল গদ্যে ওইসব কাহিনীর এমন নির্যাস তিনি পরিবেশেন করেছেন যার মাধ্যমে পাঠক প্রধানত লঘু রসের স্বাদ পেলেও তার আড়াল থেকে খুঁজে পেতে পারেন এক অন্তর্নিহিত জীবনকথা। লেখকের প্রথম গল্প প্রকাশের আনন্দের সমভাগী হয়ে যাই আমরা, আবার জাফর ইকবাল যে ‘বিচ্ছু’ নামে কার্টুন আঁকতেন এবং সমাজ-পরিবর্তনের ডাক দেওয়া কিছু চেনা মানুষের কাছ থেকে সামান্য স্মানী আদায় করতে তাঁকে যে গ্লানির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তা পড়তে গিয়ে, আত্মজীবনীর ধারায় আমরা এক তরুণ লেখককে যেমন, তেমনি তাঁর সমকালকে চিনে নিতে পারি। এই বইয়ের নানান ঘটনা থেকে এক উদ্ধীপ্ত ও বুদ্ধিপটু তরুণকে আবিষ্কার করতে পারি, খেয়ালি সেই তরুণের সৃজনশীলতার পথ হাঁটাও বুঝে নিতে পারি। নানান রসিকতার ছোট ছোট গল্প আছে এই গ্রন্থে, তাতে আমরা মাঝে মাঝে সরস কৌতুকে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠি, কিন্তু আবার চিনে নিতে পারি জীবনসংগ্রামে ব্যাপৃত এক তরুণকে। ঠিক দারিদ্র্য নয় যদি-বা, কিন্তু আর্থিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করছে ওই তরুণ হাসিমুখে। আকাশছোঁয়া দামের জন্য যে আসবাবপত্র কিনতে না পেরে, কিনে আনে কাঠ আর কাঠিমিস্ত্রির যন্ত্রপাতি। নিজেই বানিয়ে নেবেন প্রয়োজনীয় আসবাব। স্মৃতি খুঁজে বার করেছেন, এঁকেছেন চমৎকার সব চরিত্র, যাদের মানিয়ে যায় যে কোনো জীবনঘনিষ্ঠ কাহিনীতে। দেখতে পাই লেখক নিজেই পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে নিহত পিতার লাশ তুলছেন মাটি খুঁড়ে। এই আত্মজীবনীতে বেশিটা জায়গা জুড়ে রয়েছে তাঁর বন্ধু-সহপাঠীরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও লেখকের শিক্ষার্থী-জীবনের ইতিকথা আমাদের কাছে শুধু সামাজিক উপাদান হিসেবে ধরা দেয় না, কথকের বর্ণনার ভঙ্গির ভেতর দিয়ে তা অনবদ্য সাহিত্য হয়ে ওঠে।
ভূমিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জীবনটা ছিল অসাধারণ। অনেকদিন থেকেই ভাবছি আমি সেই সময়টুকুর কথা লিখে রাখি, শুরু করে আবিষ্কার করলাম কাজটা সহজ নয়। গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনা ভুলে বসে আছি অথচ একেবারে তুচ্ছ কোনো ঘটনার খুঁটিনাটি সবকিছু মনে আছে। লিখতে গিয়েও দেখি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই; জীবনের তুচ্ছ ঘটনাগুলোই ঘুরেফিরে উঠে এসেছে।
তখন মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার সময় কম, চোখে তখন একধরনের রঙিন চশমা। সেই রঙিন চশমার এমনই জাদু যে তুচ্ছ সাধারণ ঘটনাকেই অসাধারণ মনে হয়- আসলে আমার তো কিছু করার নেই!
মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট ১২ ডিসেম্বর ২০০৬
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরী পাঠকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি মূলত এ দেশের একজন বিখ্যাত লেখক, পদার্থবিদ এবং শিক্ষাবিদ। কিশোর সাহিত্য, শিশুতোষ গ্রন্থ, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, গণিত বিষয়ক বই এর জন্য খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা বাবা ফয়জুর রহমানের চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলাতেই তিনি পড়াশোনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে পিএইচডি ডিগ্রী অজর্নের উদ্দেশ্যে স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি সম্পন্ন করে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ ল্যাবেও গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সবসময়ই এ দেশের কিশোর-কিশোরীদের কাছে বিশেষ আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে। কিশোর সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক অজস্র গ্রন্থ দিয়ে তিনি আলোকিত করে তুলেছেন এদেশের অগণিত কিশোর-কিশোরীর মনোজগত। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সমূহ, যেমন- দীপু নাম্বার টু, আমার বন্ধু রাশেদ, আমি তপু, শান্তা পরিবার, দস্যি ক’জন ইত্যাদি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। তার বেশ কিছু গল্প পরবর্তীতে নাটক ও চলচ্চিত্র হিসেবে টিভি পর্দায় স্থান করে নিয়েছে। তিনি একজন বিশিষ্ট কলামিস্টও। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডও তাঁর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সমগ্র সকল বইপড়ুয়াকেই আকৃষ্ট করে। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বহুবার পুরষ্কৃত হয়েছেন। বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (২০০৪) এবং শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার (২০০৫) সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক (২০০২), শেলটেক সাহিত্য পদক (২০০৩), ইউরো শিশুসাহিত্য পদকসহ (২০০৪) অগণিত পুরষ্কার অর্জন করেছেন গুণী এই সাহিত্যিক।