ভূমিকা বাঙালি আত্নবিস্মৃত জাতি ,বাঙালির কোনো ইতিহাস নেই-এমন খেদোক্তি অনেক মনীষীর মুখেই আমরা শুনেছি। কয়েক সহস্রাব্দের ধারাবাহিক ইতিহাসের গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে যে জাতি ,তাদের প্রসঙ্গে এমত উক্তি ইতিহাস চেতনার একটি জটিল সমস্যার দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনামলে আপন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর যে বিযুক্তি ও ব্যবধান রচিত হয়েছিল, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। উপনিবেশিক আদর্শ ও শিক্ষাব্যবস্থা উপেক্ষা করেছিল জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। অনেত যোগ্য ঐতিহাসিক ও জ্ঞান সাধকের কল্যাণে ইতিহাসের অনালোকিত অধ্যায়গুলো ক্রমে ক্রমে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে জাতি পরিচয়ের সঙ্কট ও বিভ্রান্তি সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছিল। যে-দ্বিজাতি -তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল পাকিস্তান, জাতিসত্তাকে তা সম্প্রদায় বিবেচনা দ্বারা বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করতে প্রবল প্রয়াস গ্রহণ করেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই এর প্রথম শিকার হয়েছিল ইতিহাসের যুক্তিবিচার। পাকিস্তানি রাষ্ট্র-কাঠামো যত জঙ্গি ও মজবুত হয়েছিল ,ইতিহাস নিয়ে কালাপাহাড়ি কাণ্ডকারখান হয়েছিলো ততো জোরদার। অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে সুমহান স্বাধীনতার যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি তার নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো ১৯৭১ সাল। যথার্থ অর্থে ঐতিহাসিক এই ঘটনা জাতি পরিচয়ে গর্বিত হওয়ার বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনা আমাদের সামনে মেলে ধরেছে। কিন্তু অতীতের জের ও পিছুটান তো রাতারাতি বিলুপ্ত হবার নয়। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ,সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পশ্চাদমুখিতার প্রাবল্য আমরা প্রতিনিয়তই অনুভব করছি। আমাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাক্রম থেকে শুরু করে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই ইতিহাস সম্পৃক্তি এখনও যথাযথ ভিত্তি অর্জন করলো না। অথচ আগামী শতকের অভিযাত্রায় দৃপ্তভাবে এগোতে হলে জাতিসত্তার ইতিহাসের গর্ব আমাদের বড় সহায় হতে পারে। এই গ্রন্থের প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে চূড়ান্ত বাস্তবায়ন পর্যন্ত সমুদয় দায়িত্বই পালন করেছেন নিষ্ঠাবান গবেষক প্রীতভাজন মোহাম্মদ হাননান। আলোকচিত্র সংগ্রহ ,নির্বাচন এবং চিত্র- পরিচিতি ও ইতিহাস ভাষ্য রচনা -সমস্ত কাজই তাঁর করা। এ গ্রন্থের যা কিছু কৃতিত্ব তার সবটুকু তারই পাওনা। প্রধান সম্পাদক মূলত উৎসাহদাতা ও পরামর্শকের ভূমিকাই পালন করেছেন। এমন একটি গ্রন্থ প্রকাশ কোনো একক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্রায়তন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সাধ্যর অতীত। তবে আমাদের সাধের কোন সীমা -পরিসীমা ছিল না। এ কারণেই বইটি শেষ পর্যন্ত প্রকাশ পেতে পেরেছে, তবে এর নানা সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে্রও আমরা পরিপূর্ণরূপে সচেতন। আশা করি পরবর্তী সংস্করণের আগে বিদগ্ধ পাঠকসমাজের কাছ থেকে আরো উপকরণ ও পরামর্শ আমরা লাভ করবো। মফিদুল হক ফেব্রুয়ারি,১৯৯৫
ড. মােহাম্মদ হাননান সহস্রাব্দ ও শতাব্দীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইত্যাদির ওপর যে। সংগ্রহ-সংকলনটি করেছেন তা অনুসন্ধিৎসু যে-কোনাে পাঠকের কাছেই বিশ্বকোষের স্বাদ এনে দেবে। শতাব্দীর বাংলাদেশ, শতাব্দীর বিশ্ব, সহস্রাব্দের বাংলাদেশ, সহস্রাব্দের বিশ— গ্রন্থ চারটিকে নানাভাবেই সাজানাে যায়। এখানে পাঠক বাংলাদেশকে পাবেন দু’ভাবে-শতাব্দী ও সহস্রাব্দের মতাে করে, আবার বিশ্বকেও পাবেন শতাব্দীর পাশাপাশি সহস্রাব্দের পটভূমিতে। শতবছর অথবা হাজার। বছরের পরিক্রমায় বাংলাসমাজ ও বিশ্বসমাজ এভাবেই গ্রন্থ চারটিতে মূল্যায়িত হয়েছে।