সরকারী জুলুম ও নির্যাতনের কথা সন্ত্রাসবাদীরা যে-নির্যাতন সহ্য করেছে পৃথিবীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তা বিরল। গ্রেপ্তারের পর তাদের কেবল কিল ঘুষি বুটের লাথিই মারা হত না, লোহার ডাণ্ডা দিয়ে মাথায় হাঁটুতে কনুই-য়ে জোর আঘাতের ফলে কত যুবক অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। কাউকে কাউকে দশ বারো দিন না খেতে দিয়ে দেয়ালের হাতকড়ী দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হত; প্রতিদিন অজ্ঞান হয়ে গেলে মাথায় তেল জল দিয়ে জ্ঞান ফিরে এলে আবার হাতকড়ী দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হত। মাসের পর মাস নির্জ্জন কক্ষে বন্দী রেখে মাঝে মাঝে রাত্রিতে তালা খুলে ঘুম থেকে টেনে তুলে প্রশ্ন করা হত : ‘কি জান—বল।’স্বীকারোক্তি না পেলে সার্জেন্ট ও পুলিসের বুট চলত সজোরে, হতভাগ্য বন্দীর বুকে মাথায়, চোখে, তলপেটে। একদিন মাঝ রাত্রিতে কলকাতা দালান্দা হাউসের বন্দীরা বিকট চীৎকার শুনে জেগে উঠেছিল। একটি রুদ্ধ কক্ষ থেকে প্রথমটায় করুণ আর্তনাদ শোনা যায়; তারপর মারের দুপ্ দুপ্ শব্দ তারপর সব চুপ। কতজন কোর্টে গিয়ে হাকিমকে মুখে, কপালে, পিঠে, হাতে, পায়ে লাঠির আঘাতের চিহ্ন দেখিয়েছে। সরকার পক্ষ থেকে উত্তর হত ঃ ‘আসামী নিজে দেয়ালে মাথা খুঁড়ে মরতে গিয়েছিল' অথবা কখনো উত্তর দেয় : ‘আসামী পুলিসকে মারতে গিয়ে নিজেও আহত হয়েছে।' এর উপর আর কোনো কথা কওয়ার অধিকার ছিল না। নখে ছুঁচ ঢোকানো, ঘাড়ের চুলে উল্টা দিকে হেঁচকা টান দেওয়া, হাতের আঙুলে লাঠির আঘাত, জোরে কানমলা এ-সব তো ছিলই। এ-ছাড়া আরো কত রকম নিদয় অমানুষিক নির্যাতন চলে যার সঙ্গে মধ্যযুগীয় শাস্তিরই তুলনা করা চলে। আমি যখন প্রথমে জেল খাটি তখন ময়মনসিংহের সরার চর মামলার “লাহিড়ী” নামক এক কলেজের ছাত্র-বন্দীকে দেখি। সে বাঁকা হয়ে হাঁটত, মাথাটাও তার কোথাও উঁচু, কোথাও বাঁকা ছিল। একদিন কিছু কিছু কথা হওয়ার পর জাল্লাম, ধরা পড়ার পর পুলিস তাকে কি নিদারুণ নির্যাতন করেছে। আমি তার মর্মান্তিক কাহিনী শুনে কান্না সম্বরণ করতে পারিনি। সে ১৯১১ সালের কথা। পুলিসের অত্যাচারই লাহিড়ীর দৈহিক বিকৃতির কারণ ছিল।