রান্নাঘর শব্দটিই এখন প্রায় হারিয়ে গেছে। রান্নাঘর হয়ে উঠেছে কিচেন। কিচেনে রেসিপি অনুসারে ডিশ কুক করা হয়। পদ রান্না করা হয় না। রান্নাঘরের গালভরা নাম ছিল রসুইঘর। সেখানে বাড়ির গিন্নিরা রান্না করতেন। শাশুড়ি ঠাকরুণের তত্ত্বাবধানে, বাড়ির বড়, মেজো, ছোট বউমা, ননদিনিরা, বিধবা কিংবা নাইয়রী মাসি-পিসি এই রান্নাঘর জুড়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প বুনতেন আর সপ্তব্যঞ্জন রান্নার জোগান দিতেন। কেটে, বেটে রেঁধে খাবার বেড়ে খাওয়াতেন বাড়ির পুরুষদের, কখনো কখনো অতিথি নারায়ণকে। সে এক উজ্জ্বল সংস্কৃতি ছিল বাঙালির। আয়োজনের প্রাণস্পর্শে সেই খাবার হয়ে উঠত ‘অমৃত’। জমির দীঘা ধানের চাল, পালংশাক, লালশাক, পাটশাক, মানকচু সেদ্ধ, পুঁই চচ্চড়ি, মুগ, মসুর, মাষকলাইয়ের ডাল, খিচুড়ি, কচুরি, পুরি, বেগুনভাজি, নলা মাছ, লাউয়ের ঘণ্ট, নলেন গুড়, সদ্য ভাজা মুড়ি, রসপুলি, সরষে ইলিশ, কই মাছের পাতুরি, ইচামাছ, নাড়ু, মোয়া, পায়েস, পিঠা যেন রূপকথার জগৎ থেকে নেমে আসা সব খাবার। খাবারের মানুষগুলো। আর তাদেরকে ঘিরে একান্নবর্তী পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন মিলেমিশে একসময় এক ঘরে পাত পড়ত। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে খাবারেরও রূপ বদল হতো। সঙ্গে যুক্ত হতো ছড়া, শোলোক, গান, ব্রতকথা আর রূপকথা। ধীরে ধীরে এসব এখন স্মৃতিকথা হয়ে গেছে। আরও কিছুকাল পরে হয়তো স্মৃতি থেকেও উধাও হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে আমাদের রসুইঘর আর তাদের একান্নবর্তী রোয়াকের মানুষগুলো। স্মৃতি ভদ্র গল্পকার। তিনি লেখেন গল্পের ভঙ্গিতে। তাই নিতান্ত খাদ্যখাবারও হয়ে ওঠে গল্পের মতো ঘটনাপূর্ণ মনোহর। তাঁর হাতে রয়েছে এক রূপভাষ্য। সবকিছু ছবি হয়ে ফুটে ওঠে পাঠকের চোখের সামনে। হারানো স্মৃতিকেই তিনি ফিরিয়ে আনেন। মর্মে গেঁথে দেন অনায়াসে। স্মৃতি ভদ্র এক জাদুকরী শৈলীতে এক বালিকার চোখে দেখা রসুইঘরের রোয়াকের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির হাজার বছরের শান্ত, স্নিগ্ধ, সুখী গার্হস্থ্য গাথা বলেছেন এই গ্রন্থে। বইটি অবশ্যপাঠ্য হয়ে উঠেছে।