রাজিনের ঈদের আনন্দ রাজিন থাকে মিরপুরের এক নম্বরে। এটা রাজিনের দাদুর বাড়ি। দাদু চাকরি থেকে অবসরে যাবার সময় জমানো টাকা দিয়ে এই ছোট্ট বাড়িটা তৈরি করেন। মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের পাশে তাদের বাড়ি। রাজিনরা এক ভাই এক বোন। পুরো বাড়িতে একেক তলায় একেক চাচারা থাকেন। মেজ চাচা থাকেন একতলায়। খুব মজার মানুষ। তিনি বিয়ে করেননি। রাজিন এই কাকাকে খুব ভালোবাসে। সারাদিন সে একতলায় থাকে। রাতে ঘুমায় পর্যন্ত কাকার সাথে। কাকা ভালো রান্না করেন। রাজিনের জন্য ভারিমজার মজার খাবার রান্না করেন। কাকা যখন দুপুরে বাসায় থাকেন তখন রাজিনকে সাথে নিয়ে খেতে বসেন। রাজিন কি কি খেতে ভালোবাসে কাকা সেদিকে খুব খেয়াল রাখেন। রাজিনের বাবা মা থাকে দোতলায়। তিনতলায় বড় চাচা। চারতলায় ছোট বাবা। রাজিনের ভারি মজা। সবখানে ছোটাছুটি করে। খেলাধুলা করে। ছোটবাবার একজন মেয়ে। নাম তার রূপকথা। রাজিন রূপকথার সঙ্গে খেলাধুলা করতে খুব পছন্দ করে। বড় চাচার এক ছেলে এক মেয়ে। অমি আর প্রাচী। অমিকে রাজিন ডাকে ভাইয়া। ভাইয়ার সঙ্গে ওর খুব ভালো খাতির। দুজনে একসাথে বাইরে ঘুরতে যায়। সন্ধ্যায় কোথাও খেতে যায়। রাজিন সারাক্ষণ অমি ভাইয়ার সাথে দুষ্টামি করে। ওকে খোঁচা দেয়। অমি ভাইয়ার পেটের ওপর শুয়ে পড়ে। মোবাইলটা ছিনতাই করে। নানারকম মজার মজার দুষ্টুমি। ঈদ এেল দুজনের ভারি মজা। সকালে একই রকম পাজামা পাঞ্জাবি পরে নামাজ পড়তে যায় একসাথে। বাসা ফিরে মেজ কাকার বাসায় একসাথে খায়। কাকার রান্না খিচুড়ি আর ভুনা গরুর মাংস। তারপর কাকা ঈদ সেলামি দেন। ঈদের দিন ঈদ সেলামি পেতে খুব ভালো লাগে। ঈদের পরদিন মজা আরও বেশি। অমি ভাইয়া বাবা মায়ের সাথে ভোরবেলা চলে যায় নানার বাড়ি। নানি বেঁচে আছেন। থাকেন মিরপুর ১০ নম্বরে। দুই মামার সাথে। রাজিন-রায়া যখন নানির কাছে যায় তখন আনন্দের সীমা থাকে না। মামাতো ভাইয়ের বয়স দুই বছর। রাজিন ওকে ডাকে ভেজলিন বলে। পিচ্চিকে নিয়ে সারাক্ষণ খেলাধুলায় ব্যাস্ত হয়ে থাকে। পিচ্চিটাও খুব মজার। সবসময় হাত পা ছুঁড়ে হাসতে থাকে। রাজিনের কোনো গ্রামের বাড়ি নেই। নানা-নানি শহরেই জীবন যাপন করেন। দাদাও শহরে থাকতেন। রাজিন জন্মের পর কোনোদিন গ্রামে যায়নি। গ্রামে থাকেনি। গ্রামের ছবি তাই রাজিনের কাছে অনেকটাই অস্পষ্ট। রাজিন গাছপালা কম চেনে। দুচারটে পাখি ছাড়া চেনে না। সব মাছের নাম সে জানে না। মাছ কিভাবে জালে ধরা হয় দেখেনি সে। কিভাবে ধান চাষ হয় গ্রামের মাঠে কিভাবে জোরে বৃষ্টি পড়ে কিছুই দেখেনি রাজিন। ওর জীবনটা আটকে আছে শহরের ফাঁদে। ওর শৈশব হচ্ছে বাড়ির সামনের রাস্তায়। নানি বাড়ির ড্রইংরুমে টিভি দেখে, দুপুরে একসাথে খাইদাই, ছোটমামার সাথে গেম খেলে কম্পিউটারে। গেম খেলে দিন কেটে যায় রাজিনের। নানি রাজিনকে ছোটবেলার গল্প শোনান। ঠাকুরমারঝুলির রূপকথার গল্প শোনান। রাজিন খুব মুগ্ধ হয়। নানির কোল ঘেঁষে গল্প শোনার আননদই আলাদা। নানির বাড়ি বেড়িয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসে রাজিনরা। শরীরটা খুব ক্লান্ত। বাসায় পিরেই রাজিন শুয়ে পড়ে। ঘুম আসতে দেরি হয় না। নানির মুখে শোনা রাক্ষসদের গল্পটা মনে আছে। রাক্ষস আর খোক্ষসদের সাথে বন্ধুত্ব রাজিনের। দুজন এসে রাজিনের সামনে দাঁড়ায়। ঈদ মোবারক বন্ধু। ঈদ মোবারক। আজ ঈদের দিন। কি উপহার চাও রাজিন। রাজিন হাসতে হাসতে বলে, আমি যা চাই তোমরা তা দেবে? নিশ্চয়ই দেব। আমি চাই অনেক খাবার। পথের শিশুদের সেসব খাবার বিতরণ করব। আর চাও? খাবার! কি রবে এত খাবার দিয়ে? রাতে যে সব কুকররা পথে পথে ঘোরে তাদের কেউ খাবার দেয় না। আমি ওদের খাবার দিতে চাই। কুকুরদের যেন খিদা না লাগে। বাহ! খুব ভালো। খুব ভালো। রাক্ষস আর খোক্ষস কি যেন মন্ত্রপাঠ করল বিড়বিড় করে। অমনি প্যাকেট করা খাবার ঝমঝম করে পড়তে লাগল। ঘুমের মধ্যে রাজিনের ঠোঁটে মৃদু হাসির ঝিলিক। ওর কাছে ঈদ এখন মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। সকল শিশুর মুখে হাসি ফুটবেÑএর চেয়ে আনন্দ আর কি হতে পারে। আমার নাম রাজিন। আমি পড়ি ক্লাস ফোরে। আমি খুব মোটাসোটা গোলগাল একটা ছেলে। খেতে খুব ভালোবাসি। আমার এই পিচ্চি বয়সেই বেশ বড়সড় একটা ভুঁড়ি তৈরি হয়েছে। আমি গাপগুপ করে খাই। চটপট করে কথা বলি। ঝটপট করে ছুটে বেড়াই। আমার একজন প্রিয় কাকু আছেন। তার নাম আমীরুল। কাকাকে আমি অনেক ভালোবাসি। আমার যা আবদার সব কাকা মিটিয়ে দেন। আমি যা চাই সব কিনে দেন কাকা। আমার দুটো সাইকেল আছে। কাকা কিনে দিয়েছেন। বাবা বলেন, শরীরের ওজন কমানোর জন্য সকাল বিকাল সাইকেল চালানো দরকার। আমি রাতে খেয়েদেয়ে বাসার সামনের রাস্তায় সাইকেল চালাই। তারপর রাতে শুয়ে শুয়ে ট্যাবে কতকিছু দেখি। ঘুমাই আমি বেশ রাত করে। ট্যাব দেখতে দেখতে রাত হয়ে যায়। কাকা, বাবা সবাই বকা দেয়। কিন্তু আমার ট্যাব ছাড়া ভালো লাগে না। সারাক্ষণ আমি ট্যাবে চোখ রাখি। গেম খেলি। বিভিন্ন মজার মজার জিনিশ দেখি। ট্যাবে চোখ রাখতে রাখতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে আমি কিছুটা বেশি সময় ধরে ঘুমাই। আমার কিছুতেই ঘুম ভাঙতে চায় না। কাকা যখন সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুম ভাঙাতে আমি খুব বিরক্ত হই। কাকা, আমার ভালো লাগে না। তুমি সরো। কাকা তখন বলে, আমি সরে যাচ্ছি। আমার দেখা পাবি না। অমনি তড়াক করে ঘুম ভেঙে যায় আমার। কাকাকে জড়িয়ে ধরে বলি, কাকা তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয়। তুমি কেন এমন জ্বালাচ্ছ আমাকে। আমার ঘুম ভাঙতে খুব কষ্ট ওহো সরি। তাই নাকি! কাকা বলেন। আমার কিন্তু ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে। দুই আমার জন্মদিন ১২ মে। এবার ১২ মে হলো শুক্রবার। কাকাকে বললাম, এবার জন্মদিনে আশেপাশে যত ছেলেমেয়ে আছে তাদের সবাইকে নিয়ে কেক কাটবো। কাকা বললেন, খুব ভালো। ১০০ জনের আয়োজন। সবার জন্য এক টুকরো কেক, এক বোতল কোক, একটা বাটার বন, একটা কলা, একটা কমলালেবু, এক প্যাকেট বিস্কুট। বাসার সামনে ১০০ জন ছেলেমেয়ে সারি বেঁধে দাঁড়ালো। আমার বাবা সবকিছু করছেন। কাকা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কাজকর্ম দেখছেন। মোবাইল ফোনে ছবি তুলছেন কাকা। আর মাঝেমধ্যে জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে, বাপপুং... ওকে একটা প্যাকেট দাও। না কাকা। ওর নাম রহিম। রহিম তো আগে একটা প্যাকেট নিছে কাকা। আহা! বেচারা। তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ভোনটুপুটু দাও ওকে একটা প্যাকেট। কাকা আমাকে বিভিন্ন নামে ডাকেন। বাপপুং, পোঙ্খু, ভোনটুপুটু, এরকম। আমি কাকার কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পারি কাকা আমাকে ডাকছেন। সবাইকে প্যাকেট দিতে পেরে আমার কি আনন্দ। প্রত্যেকে আমার হাত থেকে উপহারের ব্যাগটা নিয়েছে। সবাই খুব খুশি। সন্ধ্যায় কাকা যথারীতি একটা বড় কেক নিয়ে এসেছেন। সাথে এশো বেলুন, কনফিটি, আর চমৎকার কয়েকটা মোমবাতি। কাকা আর আমি ঘর অন্ধকার করে মোবাতি জ্বালালাম। কেক কাটলাম। তারপর কনফিটি ছুঁড়ে দেয়া হলো। ভুরভুর করে রঙিন কাগজ উড়তে লাগল। আমি অনেক অনেক খুশি।
জন্ম ৭ই এপ্রিল ১৯৬৪, লালবাগ, ঢাকা । পিতা প্ৰয়াত সাইফুর রহমান। মাতা প্ৰয়াত আনজিরা খাতুন। পিতৃব্য প্রয়াত কবি হাবীবুর রহমান, খ্যাতনামা শিশুসাহিত্যিক । শিশুসাহিত্যের সকল শাখায় সমান স্বচ্ছন্দ। ২০০৬ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। সবচেয়ে কম বয়সে খামখেয়ালি ছড়াগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন শিশু একাডেমী আয়োজিত অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার। পরে এই পুরস্কার পেয়েছেন আরও পাঁচবার । এ ছাড়াও পেয়েছেন সিকানন্দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৩), পদক্ষেপ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৫), ছােটদের পত্রিকা পুরস্কার (২০০৭), ছোটদের মেলা পুরস্কার (২০০৯/২০১০), জাতীয় ছড়া উৎসব। ২০১১ সম্মাননা, শামসুর রাহমান সাহিত্য পুরস্কার (২০১১) এবং ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল পুনর্মিলনী সম্মাননা। ২০১১ । কলকাতা থেকে অন্নদাশঙ্কর সাহিত্য পুরস্কার ২০১২। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। সবই শিশুসাহিত্য। দেশের খ্যাতিমান সকল প্রকাশনা সংস্থা থেকে এক বা একাধিক বই প্ৰকাশিত হয়েছে । দশ বছর সম্পাদক ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত কিশোর-তরুণদের উৎকর্ষধ্যমী মাসিক আসন্না-র । অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার কিশোরদের পাতা সম্পাদনা করেছেন। পাঁচ বছর । বর্তমানে চ্যানেল আই-এর জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্বে কর্মরত। সাপ্তাহিক-এর প্রকাশকও তিনি। এ ছাড়া বাংলা একাডেমির ফেলো, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থাপনা-সদস্য। প্রিয় শখ পুরোনো বই ও চিত্ৰকলা সংগ্ৰহ, বইপড়া, দাবাখেলা, রবীন্দ্রসংগীত শোনা ।