এমন ব্যতিক্রমী জীবন হয়তো এদেশের বেশ কিছু জননী-ভগিনী কিংবা দম্পতির রয়েছে। যারা পাকিস্তানি আমলে প্রবল ঝুঁকিময় জীবন বেছে নিয়ে পরম শ্রদ্ধা কিংবা মমতায় আশ্রয় দিয়ে আগলে রেখেছিলেন এদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামীদের, জেল-মামলার মধ্যেই ছিল যাঁদের জীবন। আশ্রয়দাতাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক তাঁদের ছিল না, ছিল রাজনীতির-আদর্শের অটুট বন্ধন। কেবল ভয়ভীতি উপেক্ষা নয়, নাম-সুনামের তোয়াক্কা তাঁরা করেননি। জাতি ও জনগণের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে ত্যাগ ও তিতিক্ষার উজ্জ্বল উদাহরণ তাঁরা। তাঁদের যথাযথ মর্যাদা প্রদান আমাদের জাতীয় কর্তব্য। কিন্তু এর কতটা দিতে পারছি আমরা! আমিনা আক্তার-আবদুল গফুর দম্পতি তাঁদের মধ্যে একটি অনন্য জুটি। পাকিস্তানের দুঃস্বপ্নের কঠিন দিনগুলোতে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির গোপন একটি আস্তানা আগলে রেখেছেন প্রবল দুঃসাহসে। আমিনা আক্তার সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা আশাতুননেছা, বাবা ওসমান গণি। তিনি ছিলেন মা-বাবার তৃতীয় সন্তান। ১৯৪৮ সালে একই উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের আবদুল গফুরের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আবদুল গফুর ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকায় ছাপাখানায় চাকরি করতেন। সেই সময়ে মুসলমান পরিবারে মেয়েদের শিক্ষার তেমন সুযোগ ছিল না। আমিনা আক্তারেরও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তবে তিনি নিজ চেষ্টায় বাংলা ও ইংরেজি লিখতে-পড়তে শিখেছিলেন। আবদুল গফুর গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পঞ্চাশের দশকের প্রথমভাগে তিনি আমিনা আক্তারকে ঢাকায় পার্টির গোপন আস্তানায় নিয়ে আসেন। আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট নেতারা তাঁদের নামে নেয়া বাড়িতেই আত্মগোপন করে থাকতেন। আবদুল গফুর এখন আর বেঁচে নেই। তিনি ২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল বার্ধক্যজনিত কারণে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। আমিনা আক্তার ২০২১ সালের ১৪ মার্চ প্রায় নব্বই বছরের কাছাকাছি বয়সে প্রয়াত হন। এই দম্পতির তিন সন্তান। বড় মেয়ে জেবুন্নেছা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চিফ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। ছেলে নাজমুল গফুর তিতু গ্রাফিক আর্টসে ¯œাতক করে বর্তমানে ব্যবসায়রত রয়েছেন। ছোট মেয়ে তন্দ্রিমা আহমেদ একজন সফল উদ্যোক্তা। মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের সুযোগ এবং সৌভাগ্য হয়েছে এমন মানবরতন আমিনা আক্তারকে আনুষ্ঠানিক সম্মাননা প্রদান করার। বাংলা ধরিত্রী প্রকাশনা সংস্থা গর্বিত এজন্য যে, আমরা লেখক হিসেবে আমিনা আক্তারকে পাঠকদের দরবারে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি। তাঁর স্মৃতিগাঁথা আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যের এক মূল্যবান মণিরতœ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তাঁর। পুরোপুরি স্বশিক্ষিত। যিনি তাঁর কঠিন অভিজ্ঞতাময় দিনগুলোর স্মৃতিকে উদ্ভাসিত করেছেন স্বদেশ, সময় এবং সমাজকে। ব্যতিক্রমী ঘটনাটি এখানেই। পূর্ব বাংলার বাম-কমিউনিস্ট আন্দোলনে এমন স্তরের সংগঠনকর্মীর এমন সাবলিল স্মৃতিগাথা আছে কিনা জানা যায়নি। এমনি সাহসিকা আমিনা আক্তারকে আমাদের অভিবাদন।