বাঙালির হাজার বছরের ঐহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রবহমান স্রোতস্বিনী বর্ণিল ফল্গুধারার নিযার্স বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন। এ থেকে উৎসারিত স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তার উজ্জ্বল হীরক খন্ডের দ্যুতি। পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজ জমিদারী-জোতদারী শাসন শোষণ থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় তাদের সমর্থন ও নিরঙ্কুশ রায়ে পাকিস্তান নামক অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক ও ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক যে রাষ্ট্রটির জন্ম দেয় তার প্রতি মোহভঙ্গ ঘটতে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় নি। সদ্য জন্ম নেয়া পাকিস্তানের পূর্বাংশে (অর্থাৎ পূর্ব বাংলা) বাংলাভাষীরা ছিলেন মোট জনসংখ্যার ৫৬.৪০ শতাংশ এবং উর্দুভাষীর সংখ্যা মাত্র ৩. ৩৭ শতাংশ। সর্বোপরি উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশের ভাষা ছিলো না। এই ভাষাটি ছিলো মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণির মধ্যে প্রচলিত। এই অভিজাত শ্রেণিটি তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মূল নিয়ন্ত্রক। এরা সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে শোষণ-পীড়ন-দমনের নীলনকসা বাস্তবায়ন শুরু করে মাত্র ৩. ৩৭ শতাংশ মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিয়ে। সংখ্যাগরিষ্ট ৫৬.৪০ শতাংশ বাংলাভাষী ত্বরিত বোধেদয় ঘটলো-তাদেরকে ধ্বংস ও চিরতরে দাসত্বে শৃঙ্খলিত করতেই শাসক গোষ্ঠী ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত হেনেছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় শেখ মুজিব কলকাতায়। তিনি তখন ইসলামিয়া কলেজের (বর্তমানে আবুল কালাম আজাদ কলেজ) আবাসিক ছাত্র এবং মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী অনুসারী উপদলের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তুখোর সমর্থক। তখন দেশ বিভাগকে কেন্দ্র করে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম-দাঙ্গা রুখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পাড়া-মহল্লায় মানুষের জীবন বাঁচাতে কাজ করে গেছেন । এ সময় তিনি বুঝতে পারলেন দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ একটি অভিশাপ ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত। পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রকাঠামোয় কখনও বাঙালির অধিকার আদায় সম্ভব হবে না। শেখ মুজিব দেশে ফেরার আগে কোলকাতায় তাঁর ঘনিষ্টদের সাথে এক গোপন বৈঠকে নিজের লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয় এভাবেই ব্যক্ত করেন।