"ক্রীতদাস" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: আমি? কে আমি? কোথায় জন্মেছিলাম? কোন গায়ে কোন শান্ত নদীর ধারে ছিল আমার বাড়ি? আমি জানি না। আমার সামনে আদিগন্ত আখের খেত। ঘন সবুজ চা বাগান আমার বুক পর্যন্ত উঁচু। যে-নগরী সভ্যতার গর্ব হিসেবে রাত্রি জাগে তার পথ আমি নির্মাণ করেছিলাম। চেয়ে দেখাে, আমিই সে, তােমাকে নিঃশর্তে সেবা করেছি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। তােমার বন্ধু আমাকে গুলি করে মেরেছে, তােমার ভাই পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে টেনে হিচড়ে শেকলে বেঁধে আমাকে নিয়ে এসেছে অন্য প্রান্তে। তােমার মাইনে করা লোক আমার গায়ে গরম লােহার কলম দিয়ে লিখে দিয়েছে একটি নির্দিষ্ট নম্বর। তােমরা—কেউ স্বামী কেউ স্ত্রী, কেউ পিতা কেউ মাতা বুনাে ষাঁড়ের সঙ্গে লড়িয়ে দিয়েছ আমাকে আর মজা লুটেছ। এক কোপে মাথা কেটে নিয়েছ। আগুনে পুড়িয়েছ। নির্দ্বিধায় জলে ডুবিয়ে দিয়েছ হাত-পা শেকলে বেঁধে। আমি কে, আমি জানি না। কোথায় আমার বাড়ি, আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি তুমি কে। কোথায় তােমার বসবাস! তুমি সভ্যতা। ইউরােপ, আমেরিকা, এশিয়া জুড়ে তােমার ঘরবাড়ি। সারা পৃথিবীতে তােমার বিকাশ। প্রাচীন গ্রিস, রােম থেকে শুরু করে আধুনিক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত তুমি অধিকার করেছ সমস্ত দেশকাল। তুমিই সেই অন্ধ গর্ব, তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ। তােমার ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর, সবচেয়ে কালিমাময় অধ্যায় হিসেবে—তােমার বৈপরীত্য হিসেবে তুমিই আমাকে নির্মাণ করেছ। আমার নাম দিয়েছ ক্রীতদাস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তােমার অন্ধকার আমাকে ভােলাতে পারেনি। আমি বিস্মৃত হইনি ক্রীতদাস আমার মৌল পরিচয় নয়। আমি মানুষ। আমি আর আমার আরও হাজার হাজার মুখ—আমরা মানুষ। স্বাধীন, স্বাধিকার-প্রবণ মানুষ। বিদ্রোহ করে আমরা বারবার তার প্রমাণ রেখেছি। সেই বিদ্রোহের কথাও তুমি লিখে রেখেছ তােমার বুকে। কেননা সভ্যতা—যতই তুমি বৈপরীত্যে শ্লথ হও, শেষ পর্যন্ত মানবিক না হয়ে তােমার উপায় নেই। তুমি যত মানবিক হবে, ততই তােমাকে আমার কথা স্মরণ করিয়ে লজ্জা দেব আমি। যদি ভাবাে আমি নেই, যদি ভুলতে চাও, যদি অস্বীকার করাে, তার আর কোনও উপায় রইল না। এই গ্রন্থ ধরে রেখেছে তােমাকে, আমাকে, আমাদের যন্ত্রণা ও কান্নার ইতিহাসকে। তথ্য, যুক্তি ও বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ এ গ্রন্থ পড়ে, তুমি, হে সভ্যতা আরও একবার গভীর লজ্জিত হও।