এই বৈশাখে একাত্তরে পা রাখলেন সত্যজিৎ রায় । এই সানন্দ ঘটনাকে কীভাবে সাজানাে যায়। উৎসবের ঘটায়, সেই চিন্তারই ফসল এই গ্রন্থ, গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মতাে এই আনন্দ-শ্রদ্ধাঞ্জলি। মানুষ সত্যজিতের বয়স সত্তর, কিন্তু লেখক সত্যজিৎ রায়ের বয়স মাত্রই তিরিশ। অনেকটা পরশুরামের মতােই, চল্লিশ বছর বয়সে কলম ধরেছেন তিনি। কিন্তু উপেন্দ্রকিশাের ও সাক্ষাৎ সুকুমার রায়ের উত্তরাধিকার যাঁর রক্তে, বিলম্বিত হলেও তাঁর আবিভাবকে স্বাগত জানাতে বিলম্ব করেননি পাঠককুল। লেখা এখনও তাঁর পুরাে সময়ের কাজ হয়ে ওঠেনি, কিন্তু প্রতিটি লেখাই প্রথমাবধি অধিকার করে আসছে পাঠকের পুরাে মনােযােগ । লেখক হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের জনপ্রিয়তা যেমন বিস্ময়কর, তেমনই চমকপ্রদ তাঁর বিষয় এবং স্বাদের বৈচিত্র্য। তাঁর একটি রচনারও তুলনা করা যায় না অন্য একটি লেখার সঙ্গে। একটি রচনা ফেলে তুলে নেওয়া যায় না অন্য একটি রচনাকে | তুখােড়, মেধাবী, অসামান্য পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারী ও অসীম সাহসী গােয়েন্দা ফেলুদার দুর্ধর্ষ একেকটি রহস্য-অ্যাডভেনচারে। যেভাবে যুক্ত হয় নিত্যনতুন পটভূমি ও নিত্যনব । অপরাধ-জাল, রহস্যের ঘনঘটার সঙ্গে যেভাবে মিশে থাকে কৌতুকের সরসতা, তাতে প্রত্যেকটি কাহিনী হয়ে ওঠে অপরিহার্য ও সদ্যতম। পাশাপাশি, বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী প্রােফেসর শঙ্কুর ডায়রির পাতা থেকে উঠে আসে যেসব বিচিত্র রােমাঞ্চময় উপাখ্যান, তার একটিকেও মনে হয় না পুরনাের অনুবৃত্তি । আবার যখন। সত্যজিৎ রায় গল্প লেখেন, তখন তিনি নতুন করে বৈচিত্র্যের সীমা-ছাড়ানাে অজস্র অচেনা মানুষ ও অসংখ্য অজানা বিষয় নিয়ে তাঁর একেকটি গল্প বাংলা সাহিত্যের নতুন একেকটি কীর্তিস্তম্ভ। শুধু মৌলিক রচনাতেই নয়, অনুবাদেও অনবদ্য সত্যজিৎ রায় । তাঁর অনুবাদ আসলে অনুসৃষ্টি। এ-হেন সত্যজিৎ রায়ের বিশেষ কিছু লেখাকে আলাদাভাবে বেছে নিয়ে ‘সেরা’ রূপে চিহ্নিত করা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে । কিন্তু অন্য দিক থেকে বলা যায়, যাঁর সব রচনাই সেরা, তাঁর যে-কোনও বিচ্ছিন্ন রচনা সংকলনও সেরা হতে বাধ্য। এখানে অবশ্য আরেকটি জরুরি কথা এই যে, এই সংগ্রহের নাম স্বয়ং স্রষ্টার রাখা। রচনা-নিবার্চনও তাঁরই ফলে লেখকের নিজস্ব পছন্দ ও পক্ষপাতের একটা ছবি এই সংকলনে ফুটে উঠেছে। তবে, সত্যজিৎ রায়ের লেখক-প্রতিভার সর্বতােমুখী একটি পরিচয় যাতে ফুটে ওঠে সেদিকে তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রেখেই তৈরি হয়েছে এই সংকলন-গ্রন্থ। আত্মস্মৃতিপথের পাঁচালি যখন ছােট ছিলাম’ দিয়ে শুরু হয়েছে এই গ্রন্থ । রূপকথার গল্প থেকে যেমন চয়িত হয়েছে ‘সুজন হরবােলা’, অলৌকিক বিস্ময়-শিহরনের গল্প-রূপে তেমনই নির্বাচিত হয়েছে তারিণীখুড়াের একাধিক কাহিনী। এডওয়র্ড লিয়র, লুইস ক্যারল, কি বেলকের রচনা-অনুসরণে ‘তােড়ায় বাঁধা ঘােড়ার ডিম’-এর নমুনার পাশাপাশি রাখা হয়েছে আথার কনান। ডয়ালের ‘ব্রেজিলের কালাে বাঘ’ । আছে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ও ‘গু-গাবাবা’র শুটিংয়ের সত্যি গল্পের পাশাপাশি মােল্লা নাসীরুদ্দীনের কালজয়ী কৌতুকগল্পের রসালাে সম্ভার। প্রােফেসর শঙ্কুর কল্পবিজ্ঞান গল্পগুচ্ছের সঙ্গে উপহার দেওয়া হয়েছে ‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’, ‘পটলবাবু ফিল্ম স্টার’,খগম’, ‘অসমঞ্জবাবুর কুকুর’, কি ‘বৃহচ্চঞ্চু জাতীয় একগুচ্ছ অবিস্মরণীয় ছােটগল্প ।। সর্বোপরি রয়েছে গােয়েন্দা ফেলুদার রহস্য-অ্যাডভেনচার- উপন্যাস । যেসব উপন্যাস এই সংগ্রহে, তার একটি একেবারে টাটকা, এখনও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। সূচীপত্র যখন ছােট ছিলাম ১৫ বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম ৮১, পটলবাবু ফিল্ম স্টার ৯১, খগম ১০৫, রতনবাবু আর সেই লােকটা ১২২, ভক্ত ১৩৯, অসমঞ্জবাবুর কুকুর ১৫১ , ক্লাস ফ্রেন্ড ১৬৭, বৃহচ্চঞ্চু ১৭৬, লখনৌর ডুয়েল ১৯২, তারিণীখুড়াে ও বেতাল ২০৩, শঙ্কুর শনির দশা ২১৯, নকুড়বাবু ও এল ডােরাডাে ২৪১, মরুরহস্য ২৭৩, কভাস ২৯৩, সুজন হরবােলা ৩১৩, ব্রেজিলের কালাে বাঘ ৩৩৩, ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে ৩৫৭, হুণ্ডী ঝুণ্ডী শুণ্ডী ৩৮০, মােল্লা নাসীরুদ্দীনের গল্প ৩৮৯, সােনার কেল্লা ৪০৭, ছিন্নমস্তার অভিশাপ ৪৯১, ডাঃ মুনসীর ডায়রি ৫৫৯, পাপাঙ্গুল ৬০৩, লিমেরিক ৬০৯, জবরখাকি ৬১৭, হেনরি কিং-এর অকালমৃত্য ৬১৯
সত্যজিৎ রায় এক বাঙালি কিংবদন্তী, যিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারের খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বিশ্বদরবারে। কর্মজীবনে একইসাথে চিত্রনাট্য রচনা, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, সম্পাদনা, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ, লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন অসম্ভব গুণী এই মানুষটি। ১৯২১ সালে কলকাতার শিল্প-সাহিত্যচর্চায় খ্যাতনামা এক বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে রয়েছে তাঁর পৈত্রিক ভিটা। ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ বা ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিলো যে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের। প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র জন্যই পেয়েছিলেন ১১টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, যার মধ্যে অন্যতম হলো কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘শ্রেষ্ঠ মানব দলিল’ পুরস্কার। তবে তাঁর কাজের সমালোচকও কম ছিলো না। এসব সমালোচনার উত্তরে লেখা দুটি প্রবন্ধ পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায় এর বই ‘বিষয় চলচ্চিত্র’-তে। কল্পকাহিনী ধারায় সত্যিজিৎ রায় এর বই সমূহ জয় করেছিলো সব বয়সী পাঠকের মন। তাঁর সৃষ্ট তুখোড় চরিত্র ‘ফেলুদা’, ‘ প্রফেসর শঙ্কু’ এবং ‘তাড়িনী খুড়ো’ যেন আজও জীবন্ত। একের পিঠে দুই, আরো বাড়ো এমন মজার সব শিরোনামে বারোটির সংকলনে লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। এছাড়াও সত্যজিৎ রায় এর বই সমগ্র’র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চলচ্চিত্র বিষয়ক ‘একেই বলে শ্যুটিং’, আত্মজীবনীমূলক ‘যখন ছোট ছিলাম’ এবং ছড়ার বই ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘একাডেমি সম্মানসূচক পুরষ্কার' (অস্কার) প্রাপ্তি তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন।