"আর কতদিন" বইয়ের কিছু কথা: বারবার ঘুরে ফিরে এই প্রশ্নখানা এসে বুঝিয়ে দেয়, "আর কতদিন" কোন বিশেষ দেশের গল্প নয়। আবার, কোথাও স্পষ্ট বোঝা যায়, এগল্প কোন বিশেষ ধর্ম, বর্ণ, জাতের মানুষেরও নয়। তবে ২৮ পৃষ্ঠার এই গল্পে কাদের কথা আছে!? তোমার আমার দেশ আলাদা, চল তবে যুদ্ধ করি। ধর্ম আলাদা, চল দাঙ্গায় নামি। বর্ণ আলাদা, তোমার রক্ষে নেই। যুগে যুগে, দেশে দেশে জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, বর্ণ, জাতের নামে যত অন্যায়, খুনোখুনি হয়েছে তার একটা সামগ্রিক চেহারা উঠে এসেছে এই বইটিতে। একটা বাক্সে বন্দী কতগুলো মানুষকে ছেলেমেয়ের বাধা তুচ্ছ করে দিনের পর দিন বাঁচিয়ে রাখেন এক মা, খুঁজে ফেরেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া ছেলে তপুকে। এখানটায় মনে হবে, আপনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোন গল্প পড়ছেন। কিন্তু তাড়া খেয়ে পাগলের মত ছোটা তপুর সাথে যখন একই ভাবে তাড়া খেয়ে পালানো লোকদের দেখা হয়ে যায়, আর তাদের বলতে শোনা যায়, "ওরা আমার ছেলেটাকে হত্যা করেছে হিরোশিমায়। ওরা আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়। আমার বোনটাকে ধর্ষণ করে মেরেছে আফ্রিকাতে। আমার বাবাকে মেরেছে বুখেনওয়াল্ডে গুলি করে।", ভুল ভেঙ্গে যায়। খুনি, ধর্ষকের আলাদা কোন চেহারা, দেশ, ধর্ম, জাত নেই। আবার, ধর্ষিত আর খুন হয়ে যাওয়া মানুষগুলো, তাড়া খেয়ে পালানো মানুষগুলোরও আলাদা কোন জাত নেই। মনে হয়, যেন দুটো জাত আছে। একটা জাত মার খায়, আরেকটা জাত মার দেয়! তবু মানুষ ভুলে যায়, ভুল করে। আর তাই তপুর মা ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে মূহুর্তে বদলে যান। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাক্সবন্দী মানুষগুলোর উপর চড়াও হতে যান দা, ছুরি, লোহার শিক নিয়ে। কারণ? যারা তপুকে খুন করেছে তাদের আর এদের আশ্রয়ে নির্ভয়ে ঘুমন্ত মানুষগুলোর ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, ভাষা এক। অতএব, প্রতিশোধ অনিবার্য!
বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান, যিনি শুধু একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিকই নন, একাধারে ছিলেন গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যান্য সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকারের তুলনায় অগ্রগামী, যার ফলে তাঁর কাজগুলো যুগে যুগে মানুষের দ্বারা হয়েছে প্রশংসিত ও সমাদৃত। ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার মজুপুর গ্রামে এই অসামান্য ব্যক্তি ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার নিয়ে তিনি কলকাতায় বাস করলেও ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাঁরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে চলে আসেন। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে জহির রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে এখান থেকে স্নাতক পাশ করেন। অসাধারণ প্রতিভাধর এই সাহিত্যিক সাংবাদিকতায় যোগ দিলেও পাশাপাশি সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন এবং জহির রায়হান এর বই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জহির রায়হান এর বই সমূহ এর মধ্যে 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসটি অত্যন্ত পাঠকনন্দিত এবং এর জন্য তিনি 'আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। জহির রায়হান এর বই সমগ্র এর মধ্যে আরো রয়েছে 'আরেক ফাল্গুন', 'শেষ বিকেলের মেয়ে', 'বরফ গলা নদী' ইত্যাদি উপন্যাস এবং 'সোনার হরিণ', 'মহামৃত্যু', 'জন্মান্তর', 'ম্যাসাকার' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে তিনি তাঁর ভাই শহীদুল্লাহ্ কায়সার-কে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন, এবং এরপর আর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি কখনো। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', বাংলাদেশ সরকারের 'স্বাধীনতা পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হন।