মুহম্মদ জাফর ইকবাল- বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নের রূপকল্পকারও। কেবল তা-ই নয়, শিক্ষার্থীদের কাছেও তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত। তাঁর জীবনমুখী কথা ও কাজ অনুসরণ করে অনেক শিক্ষার্থীর জীবন বদলে গেছে। অনেক পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী নিজেকে দাঁড় করিয়েছে সফলতার সোপানে। কথাগুলো যতটা সহজে বলা গেল, মুহম্মদ জাফর ইকবালের শিক্ষকতার জীবনের ইতিহাস কিন্তু ততটা সহজ ছিল না। অনেক বন্ধুর পথ মাড়িয়ে তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি জীবননাশের শঙ্কার মধ্যেও তাঁকে পড়তে হয়েছে বারবার। কিন্তু তিনি ভয় পেয়ে নুয়ে পড়েননি, ভেঙে পড়েননি হতাশায়। বরং নিষ্ঠা, সংকল্প আর দৃঢ় মনোবল নিয়ে এ দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য, শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সব ভয়-ভীতিকে পারদ তরল করে লক্ষ্যপানে ছিলেন অবিচল। কেমন ছিল তাঁর সেই দিনগুলো, কেমন ছিল তাঁর সেই কণ্টকাকীর্ণ পথচলা, তারই এক আখ্যানভাগ 'আমার সাস্ট জীবন'। 'আমার সাস্ট জীবন' মূলত মুহম্মদ জাফর ইকবালের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবনের আলেখ্য। কবে এবং কেন তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যোগদান করেন, কেমন ছিল তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও শিক্ষাব্যবস্থা, কেমন ছিল তাঁর পাঠদান ও শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্ক, কেমন ছিল তাঁর আগামীর স্বপ্ন ও বাধার প্রাচীর; কী-সব কারণে তাঁকে পরিবারসহ মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল ইত্যাকার নানা বিষয় সংক্ষিপ্ত অথচ তথ্যাকারে উঠে এসেছে গ্রন্থটির পাতায় পাতায়। কেবল তা-ই নয়, এ গ্রন্থে বাংলাদেশের প্রথম ড্রোন নির্মাণ থেকে শুরু করে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার প্রারম্ভিক পদক্ষেপের কথাও উঠে এসেছে ঘটনা পরম্পরায়, যা আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। লেখক সেসবের বর্ণনা দিয়েছেন কথাসাহিত্যের প্রাঞ্জল ভাষায়। কঠিন-কোমলের সে উপস্থাপন কখনো কখনো রসাত্মক হয়ে ধরা দিয়েছে; যা পড়া মাত্রই সেলুলয়েডের ফিতার মতো মানসপটে ভেসে ওঠে লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়টির নানা দৃশ্যকল্প। কৌতূহলী ও ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসু পাঠকের তিয়াস মেটাতে গ্রন্থটি অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এ কথা হলফ করে বলা যায়।
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরী পাঠকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি মূলত এ দেশের একজন বিখ্যাত লেখক, পদার্থবিদ এবং শিক্ষাবিদ। কিশোর সাহিত্য, শিশুতোষ গ্রন্থ, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, গণিত বিষয়ক বই এর জন্য খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা বাবা ফয়জুর রহমানের চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলাতেই তিনি পড়াশোনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে পিএইচডি ডিগ্রী অজর্নের উদ্দেশ্যে স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি সম্পন্ন করে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ ল্যাবেও গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সবসময়ই এ দেশের কিশোর-কিশোরীদের কাছে বিশেষ আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে। কিশোর সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক অজস্র গ্রন্থ দিয়ে তিনি আলোকিত করে তুলেছেন এদেশের অগণিত কিশোর-কিশোরীর মনোজগত। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সমূহ, যেমন- দীপু নাম্বার টু, আমার বন্ধু রাশেদ, আমি তপু, শান্তা পরিবার, দস্যি ক’জন ইত্যাদি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। তার বেশ কিছু গল্প পরবর্তীতে নাটক ও চলচ্চিত্র হিসেবে টিভি পর্দায় স্থান করে নিয়েছে। তিনি একজন বিশিষ্ট কলামিস্টও। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডও তাঁর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সমগ্র সকল বইপড়ুয়াকেই আকৃষ্ট করে। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বহুবার পুরষ্কৃত হয়েছেন। বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (২০০৪) এবং শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার (২০০৫) সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক (২০০২), শেলটেক সাহিত্য পদক (২০০৩), ইউরো শিশুসাহিত্য পদকসহ (২০০৪) অগণিত পুরষ্কার অর্জন করেছেন গুণী এই সাহিত্যিক।